ইকতেদার আহমেদ
দেশের অন্যান্য সাধারণ বা বিশেষ আইনের মতো সংবিধানও একটি আইন; তবে সংবিধানের সাথে সাধারণ বা বিশেষ আইনের পার্থক্য হলো এটি দেশের সর্বোচ্চ আইন, এ আইনের সংশোধন পদ্ধতি সাধারণ আইন বা বিশেষ আইন হতে ভিন্নতর এবং সাধারণ বা বিশেষ আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সংবিধান প্রাধান্য পায়।
পৃথিবীর সব দেশে আইনের সংশোধন, তা সংবিধান বা সাধারণ বা বিশেষ আইন যা-ই হোক না কেন, একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেকোনো গতিশীল সমাজে আইনের সংশোধন বিশেষত সংবিধান বা এর যেকোনো বিধানকে সংশোধন অযোগ্য করা হলে তা সমাজের পরিবর্তনশীলতার নিরিখে সময় ও যুগের চাহিদা মেটাতে পারে না। তাই পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলো সংবিধান বা এর কোনো বিধানের সংশোধন জটিলতর করা হলেও বারিত করা হয়নি।
আমাদের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদটি সংবিধান দ্বিতীয় ও দ্বাদশ সংশোধন আইন দ্বারা দু’বার এবং দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা একবার সর্বমোট তিনবার সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধন আইন দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপন করা হয়।
’৭২-এর সংবিধানে ১৪২ অনুচ্ছেদের যে অবস্থান তাতে পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা ছিল-এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও (ক) সংসদের আইন দ্বারা এ সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধিত বা রহিত হতে পারবে; তবে শর্ত থাকে যে, (অ) অনুরূপ সংশোধন বা রহিতকরণের জন্য আনীত কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এ সংবিধানের কোন্ বিধান সংশোধন বা রহিত করা হবে বলে স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাবে না; (আ) সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যুন দু-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হলে অনুরূপ কোনো বিলে সম্মতিদানের জন্য তা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হবে না; (খ) উপরিউক্ত উপায়ে কোনো বিল গৃহীত হওয়ার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তা উপস্থাপিত হলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করবেন; এবং তিনি তা করতে অসমর্থ হলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে।
সংবিধান দ্বিতীয় সংশোধন আইন দ্বারা (ক) উপদফায় বর্ণিত ‘সংশোধিত বা রহিত’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘সংযোজন, পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। উপরোক্ত সংশোধনী বলে (ক) উপদফার (অ) শর্তাংশে ‘সংশোধনী বা রহিতকরণের’ শব্দগুলো ‘সংশোধনীর’ শব্দটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং একই শর্তাংশ হতে ‘সংশোধন’ শব্দটির পরবর্তীতে বর্ণিত ‘বা রহিত’ শব্দদ্বয় অবলুপ্ত করা হয়। উপরোক্ত সংশোধনী দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদে (২) দফা সন্নিবেশন করে বলা হয় এ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোনো সংশোধনের ক্ষেত্রে ২৬ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হবে না। তা ছাড়া উপরোক্ত সংশোধনী দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদকে উক্ত অনুচ্ছেদের (১) দফারূপে পুনঃসংখ্যাত করা হয় এবং অনুচ্ছেদটির হাশিয়ায় অবস্থিত ‘সংশোধন বা রহিতকরণের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘সংশোধনের’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ ১৪২ অনুচ্ছেদ বিষয়ে -’৭২-এর সংবিধানের হাশিয়ায় উল্লেখ ছিল সংবিধানের বিধান ‘সংশোধন বা রহিতকরণের ক্ষমতা’ যা সংশোধন পরবর্তী ‘সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা’ রূপে উল্লিখিত হয়।সংবিধান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদের (১) দফায় পর্যায়ক্রমিকভাবে উপদফা (১ক), (১খ) ও (১গ) সন্নিবেশন করে বলা হয় (১ক) – (১) দফায় যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০ বা ৯২ক অনুচ্ছেদ অথবা এ অনুচ্ছেদের কোনো বিধানাবলির সংশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে এরূপ কোনো বিল উপরিউক্ত উপায়ে গৃহীত হওয়ার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হলে উপস্থাপনের সাতদিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করবেন কি করবেন না এ প্রশ্নটি গণভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করবেন। (১খ)-এ অনুচ্ছেদের অধীন গণভোট রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইনের দ্বারা নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে ও পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। (১গ)-এ অনুচ্ছেদের অধীন কোনো বিল সম্পর্কে পরিচালিত গণভোটের ফলাফল যেদিন ঘোষিত হয় সেদিন- (অ) প্রদত্ত সমুদয় ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট উক্ত বিলে সম্মতিদানের পক্ষে প্রদান করা হয়ে থাকলে, রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে; অথবা (আ) প্রদত্ত সমুদয় ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট উক্ত বিলে সম্মতিদানের পক্ষে প্রদান করা না হয়ে থাকলে রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতিদানে বিরত রয়েছেন বলে গণ্য হবে। অতঃপর সংবিধান দ্বাদশ সংশোধন আইন দ্বারা উপদফা (১ক) হতে ৫৮, ৮০ ও ৯২ক এ তিনটি অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে গণভোটের আওতাবহির্ভূত করা হয়। উপদফা (১খ) তে ‘রাষ্ট্রপতির পদে’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘সংসদ’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়। (১ঘ) উপদফা সন্নিবেশনপূর্বক বলা হয় (১গ) দফার কোনো কিছুই মন্ত্রিসভা বা সংসদের ওপর আস্থা বা অনাস্থা বলে গণ্য হবে না।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী ১৪২ অনুচ্ছেদের বর্তমান যে অবস্থান তাতে দেখা যায় সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর পর এ অনুচ্ছেদটির যে অবস্থান ছিল পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী সে অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অভিনবভাবে অনুচ্ছেদ (৭খ) সন্নিবেশনকরত সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করা হয়। অনুচ্ছেদ (৭খ) তে বলা হয় – সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।
স্পষ্টত এ অনুচ্ছেদটি দ্বারা ব্যক্তভাবে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি ও অব্যক্তভাবে মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করা হয়।
অনুচ্ছেদ ৭খ অবলোকনে প্রতীয়মান হয় যেসব অনুচ্ছেদের সংশোধনী অযোগ্য ব্যক্ত করা হয়েছে সে অনুচ্ছেদগুলো হলো সংবিধানের প্রথম ভাগে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ১, ২, ২ক, ৩, ৪, ৪ক, ৫, ৬, ৭, ৭ক ও ৭খ; দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৮ক, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৩ক, ২৪ ও ২৫ এবং তৃতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত নবম – ক ভাগ অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ১৪১ক, ১৪১খ ও ১৪১গ তে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে অনুচ্ছেদ ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৭ক ও ১৫০ এবং সংবিধানের প্রস্তাবনা।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭খ অবলোকনে প্রতিভাত অনুচ্ছেদটির হাশিয়ায় বলা হয়েছে- সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য কিন্তু অনুচ্ছেদটির আলোচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় সেখানে উপরে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধন অযোগ্য বলে আরো বলা হয়েছে মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলিও সংশোধন অযোগ্য হবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো বলতে কোন্ সব অনুচ্ছেদকে বুঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে যদিও সংবিধান নিশ্চুপ কিন্তু মৌলিক বিধানাবলি ও মৌলিক কাঠামো যে এক নয় সে বিষয়ে কারো মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় থাকার কথা নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি ঘরের মৌলিক কাঠামো খুঁটি, চতুর্পাশের বেষ্টনী ও ছাদ। এখন এসব মৌলিক কাঠামো কী কী উপকরণ সমন্বয়ে গঠিত হবে তা নির্ভর করে ঘরটি কুঁড়েঘর, নাকি দেয়াল বা বেড়ার বেষ্টনীর টিনের ছাউনিযুক্ত ঘর, নাকি ছাদযুক্ত দালান ঘর। ঘরের বৈশিষ্ট হলো- ঘর আমাদের আশ্রয়স্থল এবং আমাদেরকে রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। ঘরের ন্যায় সংবিধানেরও বৈশিষ্ট্য আছে। এ বৈশিষ্টগুলো হলো- রাষ্ট্রের শাসনকার্য কি পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, শাসকরা কিভাবে নির্বাচিত হবেন, জনগণের অবস্থান কী হবে, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা করা হবে প্রভৃতি। সরকারব্যবস্থার পরিবর্তন হলে সংবিধানের বৈশিষ্ট্যেরও পরিবর্তন ঘটে। যেমন- সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি কোনো ধরনের নির্বাহী ক্ষমতা ভোগ করেন না যদিও রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তিনি সবার অগ্রে স্থান লাভ করেন। তা ছাড়া এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র্রপতি পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। সুতরাং একটি ঘরের কাঠামোর মতো সংবিধানের কাঠামো কী হবে তা নির্ভর করে কোন্ ধরনের সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
অনুচ্ছেদ ৭-খতে মৌলিক বিধানাবলি হিসেবে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অভিহিতকরণ। এ বিষয়ে আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার ও সার্কভুক্ত রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় উভয় রাষ্ট্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ পরবর্তী বিট্রিশদের দেয়া নাম বার্মা ও সিলোন নামে অভিহিত হতো। উভয় দেশের সংবিধানেও দেশ দু’টিকে উল্লিখিত নামে অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তারা নিজ নিজ দেশের নাম ঐতিহাসিক, সংস্কৃতিগত ও ঐতিহ্যগতভাবে যা ছিল সেরূপে অভিহিত করে। উপরোক্ত দু’টি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের দেশের নাম সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সত্ত্বে তারা নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নামের পরিবর্তন ঘটায়। পৃথিবীব্যাপী এরূপ হাজারো উদাহরণ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৭খ-এর বর্ণনা অনুযায়ী সংবিধানে নবসন্নিবেশিত মৌলিক বিধানাবলি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ৪ক তে বিবৃত জাতির পিতার প্রতিকৃতি সরকারি কার্যালয়সমূহে প্রদর্শন অপরিহার্য। এ বিধানটিকে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি গণ্য করা হলে সে ক্ষেত্রে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ মৌলিক বিধানাবলি নয় এমন প্রশ্নের উত্থাপন অমূলক হবে না।
সংবিধান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা যেভাবে অনুচ্ছেদ ১৪২ এ দফা (১ক) সংযোজন করে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০ বা ৯২ক সংশোধন বিষয়ে গণভোটের শর্ত যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল তাতে দেখা যায় সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সদস্য দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পরও পুনঃগণভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দ্বারা অনুমোদনের আবশ্যকতা ছিল। নিঃসন্দেহে এ ধরনের জটিলতর সংশোধন প্রক্রিয়া জনআকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত। আর তাই জনআকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশে মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধানাবলির সংশোধনী জটিলতর করা যেতে পারে; তবে তা কোনোভাবে রুদ্ধ করা সমীচীন নয়।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের সংবিধান সে দেশের জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু আমাদের সংবিধানে যেভাবে ১৫৫টি অনুচ্ছেদের মধ্যে তিন ভাগের অধিক ৫৮টি অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ধরনের নজির নেই। আইন যেমন মানুষের কল্যাণে প্রণয়ন করা হয় ঠিক তেমন একটি সংবিধান প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের জনগণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও কল্যাণ। জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের বিষয়টিকে মাথায় রেখে সময় ও যুগের পরিবর্তনের সাথে যেমন আইনের সংশোধন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সংবিধানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সংবিধানে যেভাবে অনুচ্ছেদ ৭-খ কে সন্নিবেশন করা হয়েছে তাতে দেখা যায় যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব থাকবে তত দিন ৭-খ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত মৌলিক বিধানাবলি এবং মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য।
যেকোনো কর্তৃপক্ষ এমনকি সংসদও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও অযোগ্য ঘোষিত বিষয়ে কোনো ধরনের সংশোধনী আনার প্রয়াস নিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে যার পরিসমাপ্তি হবে মৃত্যুদণ্ডের সাজার মাধ্যমে। তাই সার্বিক বিষয়াবলি অবলোকনে প্রতীয়মান হয় অনুচ্ছেদ ৭-খতে যেভাবে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি এবং মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছে তা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। আর যদি যৌক্তিক হতে না পারে তবে অবশ্যই বলতে হবে এ ধরনের অযোগ্যতা গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও বিধানাবলি এবং এমনকি জন-আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
কমেন্ট করুন