ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি:
বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত হন দেশের প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক ও আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী
দাউদকান্দির গর্বিত সন্তান ড.জসিম উদ্দিন আহমেদ।
গতকাল ২৫ সেপ্টেম্বর রোববার বাদ জোহর তাঁকে গুলশানের সেন্টাল তথা আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এসময় তাঁর তিন পুত্র, আত্মীয়-স্বজনসহ দাউদকান্দির বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর, বিএনপির নেতা ড. খন্দকার মারুফ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা মো. মহিউদ্দিন শিকদার, নিরাপদ চিকিৎসা চাই কুমিল্লা জেলার সভাপতি কবি, মো. আলী আশরাফ খান, বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এসএম মিজান, দাউদকান্দি প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আলমগীর হোসেন, স্বেচ্ছাসেবী দ্বীন ইসলাম রাজু প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী ড.জসিম উদ্দিন আহমেদ কুমিল্লা জেলাধীন দাউদকান্দি উপজেলার
গলিয়ারচর গ্রামের কৃতি সন্তান। তিনি ভাষা আন্দোলনের অগ্র সৈনিক, আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী, জাতিসংঘের আণবিক শক্তি কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ধর্মবিষয়ক গবেষক, কবি-সাহিত্যিক ও একুশে পদক প্রাপ্ত এবং বহুগুণের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন।
গত দুইমাস পূর্বে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হলে তাঁকে প্রথমে বাংলাদেশ এভার কেয়ার হসপিটালে ভর্তি করা হয়।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডের ব্যাংককের
খ্যাতনামা একটি হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওইখানে ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ প্রায় দেড় মাস আইসিইউতে থাকার পর গত ২১ সেপ্টম্বর বুধবার বিকেল ৫:৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদের বর্ণাঢ্যময় জীবন:
ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৩৩ সালের ১লা জানুয়ারী কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গলিয়ারচর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম ওয়াজ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম-রাহাতুন্নেছা। ড.জসিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৪৮ সালে গৌরীপুর সুবল-আফতাব উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্টিকুলেশন, ১৯৫০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি, ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি এবং ১৯৫৫ সালে পর্দাথ বিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন।
তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন, ১৯৫৭ সালে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন; সাথে সাথেই আমেরিকা গমন করেন। ১৯৫৯ সালে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে এমএস, এরপর করাচী পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন।
১৯৬১ সালে ঢাকায় বদলি হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম নিউক্লিয়ার মেডিসিন কেন্দ্র স্থাপন করার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে পিএইচডি ডিগ্রী জন্য আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মিসিগানে গমন করেন এবং ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে ফেরত এসে ঢাকা আণবিক শক্তি কেন্দ্রে আণবিক বিকিরণ বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান দেন।
১৯৬৮ সালে করাচী আণবিক শক্তি কমিশন হেড অফিসে বদলি হন এবং ডাইরেক্টর পদে থাকাকালীন সময়ে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার স্পনসরশিপে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি ভিয়েনাতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৪ বছর চাকরি করেন এবং আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিভাগের ডাইরেক্টর এবং প্রধান থাকাকালীন ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তারপরও ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তিনি এই বিষয়ে প্রায় ৪০ টি দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ডস, কোডস, গাইডস এবং টেকনিক্যাল রিপোর্ট নিয়মাবলি, নীতি, উপদেশবলী বিষয়ক ২০ টির ও বেশি বই প্রস্তুত করেন, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশে ব্যবহৃত হয়। ভিয়েনায় মসজিদ নির্মাণে সহায়তাসহ জাতিসংঘ বিল্ডিং-এ জুম্মার নামাজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় ১২ বছর সেখানে জুম্মার খুতবা দেন তিনি।
ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরে যেসব সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়, সবগুলোতে ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ অংশগ্রহণ করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিলে যোগ দেন তিনি। এসময় মিছিলে পুলিশ বাধা ও লাঠিচার্জ করলে তিনি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ওইদিন বিকেলে ডিস্ট্ক্টি ম্যাজিস্ট্রেট কোরায়শির সিদ্ধান্ত ৩ জন পুলিশ হাঁটু গেড়ে বন্দুক নিয়ে বসে এবং গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় তিনি এবং তাঁর বাম পাশে শাহজাহান এবং ডানপাশে গায়ে গায়ে লাগানো আবুল বরকত ১২ নং ব্যারাকের সম্মুখে দাঁড়ানো ছিল। আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে বারান্দায় পড়ে যায়। তখন ড. জসিম উদ্দিন তখন বরকতের রক্তাক্ত দেহ কোলে নেন এবং রক্তে তার কাপড় ভিজে যায়।
তিনি পবিত্র কোরআনের বিজ্ঞান বিষয়ে এবং ধর্মের উপর তুলনামূলক গবেষণা করেন এবং বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বন্ধে দেশে বিদেশে ৪৬ টি বিষয়ের উপর বক্তৃতা করেন। তিনি বিদেশে থাকাকালীন বিভিন্ন দেশের সরকারি খরচে ৭৪ টি দেশ ভ্রমণ করেন। তাছাড়া তিনি ১৮টি ভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গণেও ছিল তাঁর পদচারণা।
তিনি সাঁতার ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন এবং মেডেলে অলংকৃত হন।
রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপরেও একাধিক সিডি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
বাংলাদেশে আসার পর ২০০২ সাল হতে নিরন্তরভাবে ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ সাহিত্য সাধনায় ব্রত হন। তাঁর লেখা কবিতা-ছড়া ও বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখা সমৃদ্ধ বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১ শত। সাহিত্যাঙ্গণে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থের নাম-‘হয়তো কিছু না’ তাঁর প্রতিটি বই বাংলায় লেখার পাশাপাশি তিনি ইংরেজিতেও লিখতেন।
কমেন্ট করুন