স্টাফ রিপোর্টার
সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় জরুরি তলব করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সিলেট জেলা ও মহানগরীর অন্তর্ভুক্ত শাখা কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রেক্ষাপটে চার নেতাকে গণভবনে তলব করা হয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করবেন তারা।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন সোমবার রাতে বলেছেন, সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনার জন্য তাদের ডাকা হয়েছে। দলের ঐক্য প্রয়োজন। সামনে জাতীয় সম্মেলন রয়েছে। সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মহানগরের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন যুগান্তরকে ঢাকায় জরুরি তলবের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, আজ বেলা ১১টায় তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা সোমবার জানায়, সিলেটে কমিটি গঠন নিয়ে সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলন করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন পদবঞ্চিতরা। এই দ্বিধাবিভক্তি এমন সময় প্রকাশ্যে এসেছে যখন বিএনপি সিলেটে বড় ধরনের জমায়েতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অবস্থায় বিশৃঙ্খলার লাগাম টেনে ধরতেই জরুরিভাবে চার নেতাকে ঢাকায় তলব করা হয়েছে।
এদিকে সিলেট জেলা ও মহানগর নেতারা দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অনেক আগেই তারা আবেদন করেছিলেন। হঠাৎ সোমবার সন্ধ্যায় তাদের ঢাকায় যেতে বলা হয়েছে। সন্ধ্যায় শফিকুর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, সাংগঠনিক বিষয়ে নির্দেশনার প্রত্যাশায় তারা ঢাকায় যাচ্ছেন। রাতেই বিমানে তারা ঢাকায় পৌঁছেন। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় সিলেটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, মনে হয় জরুরি তলবের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার মনে হচ্ছে-উদ্ভূত সার্বিক পরিস্থিতির কারণেই তলব করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের দিরাই সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের আক্রান্ত হওয়া, হতাহতের ঘটনায় সংগঠনের সবাই ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে হাইকমান্ড উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, শুধু সুনামগঞ্জ নয়, পুরো বিভাগের ব্যাপারেই নির্দেশনা থাকতে পারে দলীয় সভাপতির। দলীয় প্রধান যখন ডেকেছেন, সাক্ষাৎ যখন হচ্ছে তখন সাংগঠনিক বিষয়ে সিলেটসহ পুরো বিভাগের বিষয়ে অবতারণা করতেই পারেন। চলমান পরিস্থিতিতে তার নির্দেশনা খুবই জরুরি।
জানা গেছে, উপজেলা কমিটি গঠন নিয়ে সম্প্রতি সিলেট জেলা কমিটির নেতারা সমালোচনার মুখে পড়েন। ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে গিয়ে চরম তোপের মুখে পড়েন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। ক’দিন পরপর মহানগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তৃণমূল নেতাকর্মীরা তুলোধনা করছেন। ফলে মহানগরীর পরিধি বৃদ্ধির পর নতুন ১৫ ওয়ার্ডে কমিটি গঠন নিয়ে ফের জাকিরকে ঘিরে বিদ্রোহের আশঙ্কা করছেন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের সভায়ও অধ্যাপক জাকিরের তীব্র সমালোচনা করা হয়।
সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিধি বর্ধিত হওয়ায় মহানগর আওয়ামী লীগ নতুন ১৫ ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলী বিশেষ সভায় বসে। তারা ১৫টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করেন। আগ্রহীদের রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্তসহ আগামী ১০ দিনের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর আবেদনপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, মহানগরীর ১২টি কমিটি হয়েছিল। এর মধ্যে ৩-৪টি ছাড়া অন্য কমিটিগুলোরও মেয়াদ শেষ। তাই মহানগরীর বর্ধিত এলাকাসহ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর স্থলে নতুন কমিটি শিগগিরই করা হবে। শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কমিটি করার সব চেষ্টা চলছে। গঠন করে দেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক কমিটিও।
সিলেটে তৃণমূল কমিটি গঠনের শুরু থেকে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। কমিটি গঠন নিয়ে সমালোচনা, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ তো আছেই। কোথাও কোথাও নেতাকর্মীরা হামলার শিকারও হয়েছে। হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।
সোমবার সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। এই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এক পক্ষের দাবি-অসুস্থতার কারণে আজমল হোসেন চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় চরম উদ্বিগ্ন দলের হাইকমান্ড। এমন প্রেক্ষাপটে আগামীকাল সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানেও দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে অপ্রীতিকর ঘটনার। দু’পক্ষের একদিকে রয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের অনুসারীরা এবং অপরদিকে প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের ছেলে আজিজুস সামাদ ডনের অনুসারীরা রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় জরুরি তলবের খবর পৌঁছানোর পর অনেকটা হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছে দলবাজ, গ্রুপিংয়ে জড়ানো সিলেটের নেতাদের মধ্যে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা চার নেতাকে এক দিনেরও কম সময়ের নোটিশে ঢাকায় ডেকেছেন। বিষয়টি ইতিবাচক নয় বলেই মনে করছেন সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব আওয়ামী লীগ নেতা যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন। পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বলেই তিনি জেলা ও মহানগরের চার নেতাকে জরুরিভাবে ঢাকায় তলব করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী তাকে শপথ পড়িয়েছেন। ঢাকা থেকে ফেরার আগেই দলীয় প্রধানের জরুরি তলবের খবর পেয়ে তিনি ঢাকায় থেকে যান। সোমবার রাতে যুগান্তরের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য নাসির উদ্দিন খানকে ফোন করা হয়। ফোন রিসিভ করেই তিনি তাড়াহুড়োর মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথা শেষ করেন।
মঞ্চে না তোলার সাহস সুনামগঞ্জের কারও নেই : আমাকে মঞ্চে উঠতে দেবে না এমন কোনো নেতা সুনামগঞ্জে এখনো পয়দা হয়নি। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদে দলীয় মনোনয়ন প্রতীক না পাওয়ায় বিদ্রোহ করে নির্বাচনে জয়ী হন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা মুকুট। মুকুট সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে শপথ নেওয়ার পর রাতে যুগান্তরকে বলেন, দিরাইয়ে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে হাইব্রিডদের নিয়ে সম্মেলন করায় এমন ঘটনা ঘটেছে। অসৎ উদ্দেশ্যে আমার শপথের দিনে সম্মেলনের আয়োজন করেছে। দলের বিদ্রোহী বলে আমাকে মঞ্চে না তোলা, অতিথি না করার কথা হাইব্রিডরা বাজারে রটিয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম আমাকে মঞ্চে উঠতে দেবে না এমন কোনো নেতা সুনামগঞ্জে এখনো পয়দা হয়নি। তিনি বলেন, হাইব্রিডরা হাওয়ায় থাকে, হাওয়ায় চলে। দল ক্ষমতায় না থাকলে একজন আমেরিকা চলে যাবেন, আরেকজন ঢাকায় গিয়ে কোট পরে চুপ করে বসে থাকবেন। তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলে না।
কমেন্ট করুন