কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক :
১৯৪৭ সালের আগে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে বড় বড় সব জাতিগোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে তাদের জাতির বা এলাকার নামে সামরিক রেজিমেন্ট গঠিত হয়েছিল। ছিল না কেবল অবহেলিত বাঙালি জাতির কোনো রেজিমেন্ট। বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে কিছু বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও যুদ্ধ শেষে সেগুলো ভেঙে দেওয়া হয়।
বাঙালিরা বিভিন্ন রেজিমেন্টে যোগদান করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং আরও অনেক স্থানীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালি সৈনিকের পাশাপাশি কমিশনড অফিসারদের মধ্যে মেজর আব্দুল গণি (১৯১৫-১৯৫৭) ছিলেন অন্যতম।
ব্রিটিশ শাসনকালে এ প্রচেষ্টা আলোর মুখ না দেখলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সূচনালগ্নেই তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল। ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল গণি। বাবা মোহাম্মদ সরাফত আলী ছিলেন কৃষিজীবী ও মা জোবেদা খাতুন আদর্শ গৃহিণী। মোহাম্মদ আব্দুল গণি ১৯৩৬ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে আইএ এবং ১৯৪০ সালে বিএ পাশ করার পর কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে এমএ গণি আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসার পদে যোগদানের জন্য আবেদন করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরে কমিশন লাভ করেন। শুরু থেকেই গণি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, নির্ভীক, বিনয়ী, কৌশলী ও কর্মতৎপর অফিসার, যা সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৪২ সালের শেষদিকে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ সময় তাকে বার্মার আরাকানে জাপানি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনে পাঠানো হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জাপানিদের দ্বারা কয়েক হাজার সৈন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল বলে মূল বাহিনী থেকে তাদের খাদ্য পাঠানো খুবই অসুবিধাজনক ছিল। পরিশেষে পাথরসংকুল পর্বতের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে ক্যাপ্টেন আবদুল গণির নেতৃত্বে আটকা পড়া ১২০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী প্রতিরোধ ভেদ করে বের হয়ে আসে। এ বিপজ্জনক সময়ে বাঙালি মুসলমান সৈনিকদের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখে ক্যাপ্টেন গণি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন তাদের নিয়ে একটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করতে। মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৬ সালে ক্যাপ্টেন গণিকে ভারতের ঝালনায় কোর সেন্টারে বদলি করা হয়। এ সময় থেকে তার চিন্তা-চেতনা কাজ করতে থাকে কীভাবে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করা যায়। এ সময়ে তিনি দাক্ষিণাত্যের বিশাখাপত্তম, হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ ও মুম্বাইয়ে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির দায়িত্ব পালন করেন, যা তার জীবনে বড় ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হিসাবে কাজে লাগে। সেখানে তিনি দুটি পাইওনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন গণি জেনারেল মেসারভিকে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করার অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন। মেসারভি এ প্রস্তাবকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন এবং উত্তরে জানান, ‘আমি আশা করি বিশ্বকে তোমরা দেখাতে পারবে বাঙালি মুসলমান সৈনিকরা অন্যান্য সৈনিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ ঝালনার কোর সেন্টারের অধিনায়ক লে. কর্নেল মারিয়াটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠনের বিষয়ে ক্যাপ্টেন গণিকে পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন গণির অধীনে পাইওনিয়ার কোম্পানি দুটি বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ছিল বলে এগুলো পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে ক্যাপ্টেন গণির নেতৃত্বে কোম্পানি দুটি বিশেষ ট্রেনযোগে মুম্বাই থেকে ঢাকায় আনা হয়।
ঢাকায় আসার পর বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য ক্যাপ্টেন গণি জোর তৎপরতা শুরু করেন। অবশেষে বাঙালি মুসলমানদের প্রাণের আকুতি, ক্যাপ্টেন গণির আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। পাকিস্তান জন্মলাভের শুরুতেই সরকার ক্যাপ্টেন গণি ও আরও অনেকের ইচ্ছানুযায়ী বাঙালি মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গঠনের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লে. কর্নেল ভি. জে. ই. প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালি মুসলমানদের বহুলপ্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল। অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর স্যারফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, মন্ত্রিপরিষদের সব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান, উচ্চপদস্থ সব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। শুরু হয় বাঙালিদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভযাত্রা এবং মার্শাল রেস হিসাবে প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। বস্তুত এর মাধ্যমে বীজ বপন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ শার্দূল’ বাহিনী। অনুষ্ঠানের চা-চক্রে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার অবতারণা হয়। ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বলেন, ‘এখন থেকে বাঙালি সৈন্যরা উর্দুতে কথা বলবে, বাংলায় নয়।’ এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, আমরা বাঙালি সৈন্যরা কখনো উর্দুতে বলব না, আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় বলব।’ এর জবাবে আইয়ুব খান, ‘শাটআপ, সিট ডাউন’ বলে ক্যাপ্টেন গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য এ সময় থেকেই তাকে ‘টাইগার গণি’ আখ্যা দেওয়া হয়। সেদিক থেকে বলা যায়, ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং মেজর গণি হলেন এ অদৃশ্য আন্দোলনের মহানায়ক। এ ঘটনার পর থেকে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন গণির অবস্থান নড়বড়ে হতে থাকে। চৌকশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তার পদোন্নতি হচ্ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল থেকে তাকে বদলি করা হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড, দিনাজপুরে। সর্বশেষ তাকে ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টার, ঢাকায় বদলি করা হয়। যথাযথ মূল্যায়ন ও পদোন্নতি না হওয়ায় ১৯৫৩ সালের শেষদিকে তিনি রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগ গৃহীত হয় এবং তাকে অবসর প্রদান করা হয়। অবসরকালীন ক্যাপ্টেন গণিকে তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অবসরোত্তর (retrospective) ‘মেজর’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তার চিন্তাচেতনা ছিল অনেক সুদূরপ্রসারী। তার সামগ্রিক চেষ্টা ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ, সাম্য, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি কায়েম, মানুষের চারিত্রিক উন্নয়ন, জনগণের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করা। তিনি সরকারের কাছে দেশ ও জাতির কল্যাণে বেশকিছু দাবি উত্থাপন করেন। যেমন-দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের যুবকদের কমিশন অফিসার হিসাবে যোগদানের জন্য ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা, সারা দেশের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরতেন। তার বক্তব্য এতই শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রত্যেক সদস্য ও স্পিকার মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করতেন। ১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে গমন করেন। এ নির্ভীক বীরপুরুষ মাত্র ৪২ বছর এ নশ্বর দুনিয়ায় বেঁচে ছিলেন।
কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি : সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com
কমেন্ট করুন