ফাতিমা আজিজ
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সংযমশীল হতে পারো’ (সূরা বাকারা-১৮৩)।
এর শরিয়তি অর্থ হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ফজর উদিত হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং যৌনবাসনা পূরণ করা থেকে বিরত থাকা। এই রোজার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো তাকওয়া, পরহেজগারি তথা আল্লাহভীরুতা অর্জন। আর আল্লাহভীরুতা মানুষের চরিত্র ও কর্মকে সুন্দর করার জন্য মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে।
রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সাওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সায়িম (রোজাদার)। যার কবজায় মুহাম্মদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের গন্ধের চেয়েও বেশি সুগন্ধি। সায়িমের জন্য রয়েছে দু’টি খুশি যা তাকে খুশি করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে’ (সহিহ বুখারি-১৯০৪)।
হাসান আল বাসরি রা: এই দিনকে মেহমানদের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই দিনে আমাদেরকে ডেকে বলে, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের মেহমান, আর মেহমানরা হয় তোমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে অথবা দুর্নাম করে বিদায় নেয়। হয় তোমাকে অতিথিপরায়ণ বলে অথবা নীচু মানসিকতার ব্যক্তি হিসেবে উল্লেøখ করে। তারা তোমার সম্পর্কে হয় ভালো বলে, না হয় খারাপ কিছু প্রচার করে। দিন আর রাতও ঠিক এরকমই, মেহমানের মতো। তারা হয় তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে আর না হয় তোমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে।’
দিন আর রাত হলো দুটি গুপ্ত ধনভাণ্ডারের মতো। তাই আমাদের উচিত প্রতিটি দিন ও রাতকে অতি সতর্কতার সাথে কাজে লাগানো।
নবী সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পেছনের সব গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সব গোনাহ মাফ করা হবে’ (বুখারি-১৯০১)।
‘সাওম কেবল আমারই জন্য’। এই হাদিসের আলোকে সাওমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে। প্রথমত, এই হাদিসের ভিত্তিতে সাওমের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সাওম শুধু আল্লাহর জন্য রাখা হয়। যার কারণে প্রতিটি ইবাদতে রিয়ার ভয়ঙ্কর আশঙ্কা থাকলেও সাওমে নেই। তাই সাওম পালনকারীর রিয়া বা লোক দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেই নির্জনে পানাহার এবং পবিত্র যৌন ইচ্ছা পূরণ থেকে বান্দা বিরত থাকে। দ্বিতীয়ত, সাওম আল্লাহর প্রিয় আমলগুলোর একটি। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের আমলগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম হলো সালাত’ (মুসনাদে আহমদ-২২৩৭৮)। এভাবে সাওমকেও আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল বলেছেন। সাওমের মাধ্যমে তাকওয়ার চাষ করে আল্লাহর কোনো প্রিয় বান্দা ১২ মাস সেই তাকওয়ার সুফল ভোগ করতে সক্ষম হয়। আর এ জন্যই আল্লাহ বলছেন, ‘যাতে তোমরা মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো’ (সূরা বাকারা)।
তৃতীয়ত, সাওমের পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জানা নেই। নবী সা: বলেন, ‘জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে’ (বুখারি-১৮৯৬)।
অন্য একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক নেক কাজের পুরস্কার ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়, কেবল সাওম ব্যতীত। সাওমের পুরস্কার কেবল আল্লাহ জানেন। আল্লাহ একে কতগুণ বর্ধিত করবেন, আর কী পুরস্কার দেবেন, সেই জ্ঞান আল্লাহ তাঁর নিজের কাছে রেখেছেনÑ প্রকাশ করেননি’ (মুসলিম)।
চতুর্থত, ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা। দ্বীন পালনের জন্য তিন ধরনের ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। প্রথমত, আল্লাহর আনুগত্য করে যাওয়ার জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, হারামকৃত কাজ থেকে বেঁচে থাকতে ধৈর্য। তৃতীয়ত, আল্লাহর বিধান আর নির্ধারিত তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার ধৈর্য। যেকোনো ইবাদতের জন্য যেকোনো একটি ধৈর্যের প্রয়োজন হয় কিন্তু সাওম পালনের জন্য এই তিনটি ধৈর্যই দরকার। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের প্রবৃত্তি মন্দের দিকেই বেশি ঝুঁঁকে থাকে’ (সূরা ইউসুফ-৫৩)। সব মন্দের ঊর্ধ্বে উঠে যখন বান্দা ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তখন আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে নিজেই এর পুরস্কার জমা রাখেন যা জানার ক্ষমতা কারো নেই।
পঞ্চমত, সাওমকে আল্লাহ কেবল তাঁরই জন্য বলার আরেকটি কারণ হিসেবে আলেমরা বলেন, এর মাধ্যমে আল্লাহ সাওমকে এক অদ্বিতীয় মর্যাদা দান করেছেন। যেমন কাবাকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলে সম্মানিত করেছেন তেমনি নিজের জন্য বলে সাওমকে অনেক মর্যাদাবান করেছেন।
ষষ্ঠত, কিয়ামতের দিনও সাওমের প্রভাব অক্ষুণœœ থাকবে। সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নাহ রাহ.-এর মতে, সাওমকে আল্লাহ কেবল তাঁর জন্য বলেছেন এর কারণ হলোÑ সাওম এমন একটি ইবাদত যার সওয়াব কিয়ামতের দিনও অন্য কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। দুনিয়ার হক নষ্টকারীর ভালো আমল যখন অন্যের খাতায় দিয়ে দেয়া হবে তখনো সাওমের আমল নেয়া হবে না। তার মতে, আল্লাহ সাওমকে নিজের বলে অভিহিত করেছেন, তাই সাওমের সওয়াব নিয়ে নেয়া হবে না।
সপ্তমত, মুশরিকরা সাওমের ক্ষেত্রে শিরক করেনি। উলামাদের মতে, সাওমের বিশেষত্ব হচ্ছে মুশরিকরাও এই ইবাদতের ব্যাপারে কখনো শিরক করেনি। মুশরিকরা তাদের ইবাদতে মূর্তির উদ্দেশে সব কিছু বিসর্জন দিলেও কখনো সাওম মূর্তির উদ্দেশে করেনি। তাই এটাই সেই বিশেষ ইবাদত যার মধ্যে কখনো শিরক প্রবেশ করেনি।
তাকওয়াকে যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সাওম হচ্ছে তাতে পৌঁছানোর একটি স্কুল। একটি হাদিসে রাসূল সা: রমজানের মর্যাদাবান দিনগুলোকে একটি মৃদুমন্দ ক্ষণস্থায়ী সুশীতল বাতাসের সাথে তুলনা করেছেনÑ যা অনাবিল প্রশান্তির সুবাস বহন করে। এই মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়াতে কারো ঠাণ্ডাও লাগে না, আবার কারো মৃত্যুও হয় না। বরং এই হাওয়া মানুষকে আনন্দ দেয়। যে এই বাতাস গায়ে মাখে, সে আর কখনো দুঃখী হবে না। এ সম্পর্কে একটি হাদিস হচ্ছে, ‘নিজেকে ওই মৃদু বাতাসে মুক্ত করো, নিজেকে রোমাঞ্চিত করো তার পরশে, নিজের বাহুগুলোকে মেলে ধরো ওই মুক্ত বাতাসে’ (মুজামুল আওসাত)।
কমেন্ট করুন