ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ এখন বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছে। কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই সমাবেশ ঘিরে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির প্রধান দুই দলের নেতারা।
একদিকে বিএনপি বলছে, এই সমাবেশের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে। কারণ সেদিন তারা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, ওই দিন পুরোপুরি সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তাদের পাহারা থাকবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশ নতুন কিছু নয়। বিএনপির এর আগে বিভিন্ন জেলায় আরও নয়টি সমাবেশ করেছে।
কিন্তু ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ কেন দুই দলের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
সমাবেশ থেকে কি অর্জন করতে চায় বিএনপি?
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই রাজপথে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল বিএনপি। এরপরে বড় কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায়নি দলটিকে।
কিন্তু গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় নয়টি সমাবেশ সফল করেছে বিএনপি। গণপরিবহন ধর্মঘট, নানারকম বাধার পরেও সেসব সমাবেশে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী অংশ নিয়েছে।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমাদের বিভাগীয় সমাবেশগুলোর সর্বশেষ সমাবেশ ঢাকায়। এর আগের সমাবেশে তো কোন কর্মসূচী দেই নেই। ঢাকার সমাবেশ থেকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি দেবো। একটা রাজনৈতিক দল হিসাবে, ১০ তারিখের পর কী করা হবে, দাবিদাওয়া তো বলতে হবে।‘
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, দীর্ঘদিন পরে বিএনপি পুনরায় যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, ঢাকার মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে সেটারই একটা ‘শো-ডাউন’ করতে চায়। রাজনৈতিকভাবে তাদের যে অনেক সমর্থন আছে, এই সমাবেশের মধ্য দিয়েই তারা দেশের মানুষ ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে তুলে ধরতে চায়।
অনেক দিন রাজপথে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না। প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে যেভাবে তারা কর্মী-সমর্থকদের সারা পেয়েছে, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা অংশ নিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে ঢাকায়ও যেহেতু এমনিতেই অনেক বেশি মানুষ, অনেক বড় সমাবেশ হবে। এটা তাদের কাছে একটা ‘শো-ডাউনের’ মতো বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘ঢাকার সমাবেশ নিয়ে বিএনপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এই জন্য যে তারা চেষ্টা করছে অনেক দিন পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে এবং তাদের জনসম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে। দলকে চাঙ্গা করার জন্য এটা তাদের খুব দরকার। তারা দেখাতে চায়, তাদের পেছনে মানুষ আছে।’
সেইসাথে দেশে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও তাদের দলের সমর্থন তুলে ধরতে চাইছে দলটি।
তবে বিএনপির নেতারা মনে করেন, তারা অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতোই একটি সমাবেশ করতে চান। কিন্তু সরকারই পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে।
বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলছেন, ‘দশটা বিভাগে আমাদের সমাবেশের সর্বশেষটা হবে ঢাকায়। নানা বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আমরা নয়টা বিভাগে আমাদের সমাবেশ শেষ করেছি। অন্যান্য জায়গায় যেরকম সমাবেশ হয়েছে, এখানেও তাই হবে। তবে সরকারই বিএনপির সমাবেশ ঘিরে যে ধরনের আচরণ করছে, সেটাই সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করছে এবং বেশি আলোচনা হচ্ছে।’
তিনি বলছেন, ‘একটা রাজনৈতিক দল তাদের সাংগঠনিক বিকাশ ঘটাবে, জনগণের সামনে তার শক্তি দৃশ্যমান করবে, জনগণের পক্ষে কথা বলবে, এটা তো স্বাভাবিক একটা গণতান্ত্রিক ধারার মধ্যে পড়ে, সাংগঠনিক অধিকারের মতো। আমার দল যদি বড় হয়, তাদের অন্যের এতো আশঙ্কা কেন?’
আওয়ামী লীগ কেন এতো গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপির সমাবেশকে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে রাজনৈতিক অনেক হিসাবনিকাশ রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মঞ্চ তৈরি করে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি।
আবার ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়ার পর তারাও অবস্থান নিয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে হয়।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা আশঙ্কা করছেন, বিএনপিকে যদি মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে হয়তো সেরকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণ আছে। বিএনপি নিজেই এই সমাবেশ নিয়ে তাদের আলাদা কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে আগে জানিয়েছে, যাতে হয়তো পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ৮ অক্টোবর মন্তব্য করেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর সরকারের পতন হবে। সেদিনের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন যে সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত খালেদা জিয়া দশই ডিসেম্বরের সমাবেশে অংশ নেবেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২২ নভেম্বর বলেছেন, ‘এখনো আমরা আসল ঘোষণা তো দেই নাই। আসল ঘোষণা আসবে ১০ তারিখে। সেদিন থেকে শুরু হবে এক দফার আন্দোলন।‘
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘যেহেতু একবছর পরে নির্বাচন আসছে, ওই নির্বাচনে তাদের দাবি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, ওই দাবির পক্ষে যে অনেক মানুষ আছে, সেটা দেখানো তাদের জন্য জরুরি। ফলে সমাবেশে তারা যত বেশি মানুষ জড়ো করতে পারবে, বড় সমাবেশ করতে পারবে, তারা মনে করে, তারা দেখাতে পারবে যে তাদের কত সমর্থন আছে।’
‘মেঠো রাজনীতিতে শো-ডাউনের একটা প্রতিযোগিতা থাকে। বিএনপির সমাবেশের পরে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগও নানারকম জনসভা করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেখানে বক্তব্য দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের জন্য ভোট চেয়েছেন। এখানে একটা পাল্টাপাল্টি শো-ডাউনের প্রতিযোগিতা চলছে। এখানে একটা আছে রাজনীতির লড়াই, আরেকটা আছে দলীয় আছে ইগোর লড়াই।‘
তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনোরকম চিন্তিত নয়, কোনো গুরুত্বও দিচ্ছে না।
‘আমার মনে হয় না আওয়ামী লীগ এটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মিডিয়া বিভিন্ন সময় প্রচারের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গিয়ে জানতে চায়, বিএনপি নেতারা এই বললো, আপনাদের বক্তব্য কি? অনেক সময় আমাদের নেতারা হয়তো বিভিন্ন বক্তব্য দেয়, তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ চিন্তিত। বিএনপির সমাবেশ বিএনপি করবে, তাতে আওয়ামী লীগের কি আসে যায়?’
‘বিএনপির সমাবেশ নিয়ে, সমাবেশের অনুমতি, স্থান নির্ধারণ-এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এখানে আওয়ামী লীগের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুব বেশি কিছু ভাবছে বলে আমি মনে করি না,’ বলছেন হানিফ।
তবে ঢাকায় ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন নেতা নানারকম বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সমাবেশের স্থান নিয়েও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলেও দলটি চাইছে নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে।
এর আগে যে নয়টি বিভাগীয় শহরে বিএনপির সমাবেশ হয়েছে, সেখানে সরাসরি কোন বাধা দেয়া না হলেও, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার এবং সরকারি দল নানানভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, যাতে বিএনপির সমাবেশে বেশি লোকজন না আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনে বলেছেন, ‘১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা (বিএনপি) জানান দিল যে, তারা সন্ত্রাস করবে। আবার আগুন সন্ত্রাস ফিরে আসছে। খেলা হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারা দেবে নেতা-কর্মীরা।‘
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর মতো ঢাকা সমাবেশেও পরোক্ষভাবে বাধা তৈরি করা হবে আওয়াম লীগের পক্ষ থেকে।
এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকার অনেক হোটেল ওই সময় খালি রাখার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।
র্যাব জানিয়েছে, ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) কিছুটা আতঙ্কিতও। আওয়ামী লীগ এবং তাদের নানান অঙ্গ সংগঠন যেভাবে বলছে, পাহারা দেবে, যে সমস্ত কথা বলছে, তাতে বোঝা যায় যে, তারা চিন্তিত। যদি কোন কারণে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বিএনপির দাবি যদি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়, তাহলে তো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করে, তাদের জন্য ভালো হবে না। ফলে তাদের মধ্যে চিন্তা আছে। আবার বিএনপিও চাইবে, যত বেশি চাপ দিয়ে এটা আদায় করার চেষ্টা করবে।‘
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই টানাপড়েনে উদ্বেগে পড়েছেন মনির হোসেনের মতো অনেক সাধারণ মানুষ।
বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে তার ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আসা ঠিক হবে কিনা, এসে কোন বিপদে পড়তে হয় কিনা, তিনি সেই চিন্তায় পড়েছেন।
‘আমার জরুরি কাজ আছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ভিসার আবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু সমাবেশ নিয়ে যেসব কথা শুনছি, তাতে এখন তো ঢাকায় যেতেই ভয় পাচ্ছি, কি হয় না নয় ভেবে। কিন্তু এখন পরীক্ষাটা করাতে না পারলে আমার বিদেশে যাওয়া তো পিছিয়ে যাবে,’ বলছিলেন মনির হোসেন।
কমেন্ট করুন