আমাদের দেশে বর্তমানে মৌলিকভাবে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে : একটি হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষা আর অপরটি বৈষয়িক শিক্ষা। ফলে সমাজে দুই ধরনের লোক তৈরি হচ্ছে- এক হলো, মাদরাসা পড়ুয়া সমাজ। যাদের মৌলিক কাজ হচ্ছে দ্বীনি ইলমের চর্চা, সংরক্ষণ ও প্রসার। বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে তাদের আগ্রহ যৎসামান্য।
আর অপর শ্রেণীটি হচ্ছে বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী সাধারণ শিক্ষিত সমাজ। শিক্ষাব্যবস্থার সেকুলারিকরণের ফলে দিন দিন এ ধারা থেকে দ্বীন-ইসলামের জ্ঞান ও চর্চা হারিয়ে গেছে। এর বিপরীতে দ্বীন ও ধর্মের প্রতি তাদের মনে জন্ম নিয়েছে অজ্ঞতা, অনাগ্রহ ও ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ। ফলে সাধারণভাবেই তারা ইসলামী আদর্শবাদী জীবনযাপনে হয় অক্ষম।
এই ব্যবস্থাটি শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই দু’টি বিপরীত শ্রেণী তৈরি করেনি; বরং চিন্তা ও মননে এবং সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক ভারসাম্যতাকেও দু’টি সাংঘর্ষিক প্রবাহে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। একটি জাতির শিক্ষিত অংশের এরূপ বিপরীত দু’টি ভাবধারায় গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য ও উন্নতির পথে এক ধরনের বাধা। যদিও উভয় শিক্ষাব্যবস্থার বেশির ভাগই মুসলিম। কিন্তু চিন্তা ও চর্চার বৈপরিত্য এই জাতিসত্তাকে গৌণ করে দিয়ে একটি নিঃসীম যুদ্ধে লিপ্ত করে দিয়েছে আমাদের মেধাশক্তিকে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা কি আদৌ এখানে সম্ভব বা সেটি সমাধান কী না, এ বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা কথা বলবেন। আমরা যে বিষয়টিতে ফোকাস করতে চাচ্ছি তা হলো- বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের করণীয় কী? সে প্রশ্নের উত্তরে আমরা একটি সমাধান প্রস্তাব করেছি, আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব। এই আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মেধাসম্পদের সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। দেশের উন্নয় ও অগ্রগতিতে উভয় ধারার মেধাকে কাজে লাগানোর একটি পথ তৈরি করা। এখন আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কী হবে, সেটি বলার আগে প্রথমে উভয় শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক কিছু দর্শন আলাপ করা যাক।
‘মূলগতভাবে শিক্ষা ও জীবন পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। কোনো জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদর্শন সেই জনগোষ্ঠীর জীবন-দর্শন ও জীবন পদ্ধতিরই নামান্তর। অন্য কথায়, জীবন-দর্শন ও শিক্ষাদর্শন মৌলিকভাবেই এক। শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার চিন্তাবিদদের মধ্যে যে মতবিরোধ, তা আসলে জীবন-দর্শন পর্যায়ের মতবিরোধেরই বহিঃপ্রকাশ। যে জাতির জীবন-উদ্দেশ্যই হচ্ছে নিছক বস্তুগত, ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর, তার শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচি, বই-পুস্তক, শিক্ষাপ্রকল্প-শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তার গোটা পরিবেশই হবে ক্ষয়িষ্ণু ও সীমাবদ্ধ জীবন-দৃষ্টির পরিচায়ক।
পক্ষান্তরে কোনো জাতির দৃষ্টিতে এ নশ্বর জীবন যদি হয় শুধু একটি চলার পথে একটি ‘উসিলা’ মাত্র, আর চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনের সাফল্যই যদি হয় মঞ্জিলে মকসুদ, তাহলে তার গোটা শিক্ষাব্যবস্থার একটি সামান্য অনুষ্ঠানই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেবে, এর মূলে রয়েছে পরকালের প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও পরকালীন কল্যাণ লাভই এর চরম লক্ষ্য।
এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মজবুত যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থাকে মানব জীবনের চরমতম বস্তুগত লক্ষ্য ও বৈষয়িক উন্নতি লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। কেবল বৈষয়িক উদ্দেশ্যই নয়, আপনি যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই অর্জন করতে চান না কেন, আপনার শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুরূপ ফলদায়ক করে গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই আপনার থাকতে পারে না।
তবে বিস্তারিত পর্যালোচনার আগে আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, আমাদের জীবন দর্শন কী হবে। আমাদের জীবন দর্শন যেমন হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও তেমনই হবে। এ উভয় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে, আমাদেরকে উভয় শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস, সম্ভাবনা ও সঙ্কট সম্পর্কেও খানিকটা জানতে হবে।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিলে আমরা দেখব, ১৯৪৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা লাভের পর এ অঞ্চলের জাতি ও রাষ্ট্র যেসব গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তন্মধ্যে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থাই ছিল প্রধান- যার মৌলিক সমাধান হওয়া অপরিহার্য ছিল সর্বপ্রথম। কেননা, একটি আদর্শবাদী দেশ ও রাষ্ট্রের পক্ষে শিক্ষা সমস্যাই হয় জীবন-মরণের সমস্যা। বিশেষ করে এ কারণে যে, উত্তরাধিকার সূত্রে এ অঞ্চলের জনগণ যে শিক্ষাব্যবস্থা লাভ করেছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকার ছিল তাদেরই প্রাক্তন প্রভু সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। তারা এ দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল তার স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করার জন্য তিনটি কথা মৌলিকভাবে মনে রাখাতে হবে।
একটি হলো এই যে- ইংরেজ ছিল তখন পাশ্চাত্যের, বস্তুবাদী সভ্যতার অগ্রণী। একটি বস্তুবাদী সাম্রাজ্যবাদী জাতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা অবশ্যই বস্তুবাদী চিন্তা ও দর্শনমূলক হবে; নিতান্ত বৈষয়িক ও উপস্থিত ‘সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং নীতিহীন ভোগবাদ ও স্বার্থবাদই হবে সে শিক্ষাব্যবস্থার মৌল দৃষ্টিকোণ। এটি খুবই স্বাভাবিক কথা- এর ব্যতিক্রম ধারণাও করা যেতে পারে না।
আর দ্বিতীয় কথা হলো- ইংরেজ ছিল এ দেশের বিজয়ী প্রভু, মালিক-মুখতার। সেই প্রভুরা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তারা ছিল তাদের বিজিত গোলাম। গোলাম জাতির জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা তারা স্বভাবতই চালু করতে পারে না, যা এ গোলামদের প্রভু বানিয়ে দিতে পারে কিংবা প্রভু হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারে। অন্য কথায়, গোলাম জাতিকে আরো গোলাম বানানোর উপযোগী শিক্ষাই তারা নিতে চেয়েছে, প্রভু বা স্বাধীন জাতির উপযোগী শিক্ষা নিশ্চয়ই দিতে চায়নি।
আর তৃতীয়ত- এ কথাও উপেক্ষণীয় নয় যে, ইংরেজরা ছিল কট্টর খ্রিষ্টান; তারা এই বিশাল অঞ্চলের রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। আর এ রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয়ার সময় তারা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল কেবল মুসলমানদের তরফ থেকেই। এ কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিল চরম মুসলিমবিদ্বেষী ও মুসলমানদের ঘোরতর দুশমন। তারা স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিল, মুসলমানদের জিহাদি শক্তির উৎস যে জীবন দর্শন ও যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাকে নিঃশেষে খতম না করা পর্যন্ত এই লোকদের ওপর ইংরেজ শাসনের মজবুত বুনিয়াদ কায়েম হতে পারে না।
এই তিনটি দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে আলীগড়ের কথা বলা যেতে পারে। যে বিপুল সম্ভাবনা ও ইংরেজ প্রতিরোধের স্বপ্ন নিয়ে আলীগড়ের জন্ম হয়েছিল পরে তা পরিণত হয়েছিল এক নিষ্প্রাণ প্রচেষ্টায়। তাই এ কথা পরিষ্কার, ইংরেজের প্রবর্তিত সে শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন দেশ ও জনগণের জন্য কোনো দিক দিয়েই উপযুক্ত ছিল না। দেশ বিভাগের পর তা এখানে এক দিনের তরেও চালু থাকা উচিত ছিল না; বরং অবিলম্বে সে শিক্ষাব্যবস্থা বদল করে এ দেশের জনগণের উপযোগী একটি আদর্শভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা একান্ত কর্তব্য ছিল। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্যই এখানে যে, এ দেশে তা করা হয়নি।
এ দেশের ‘জাতীয় শিক্ষা’ব্যবস্থার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া হয়, তার সাথে এ দেশের শিক্ষার্থীদের মনের সংযোগ বা অন্তরের গভীরতর সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। কেননা, তার বলতে গেলে পুরোটাই ইসলামের বিপরীত- ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন; ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সাথেও তার নেই কোনো সামঞ্জস্য। ফলে মুসলিম যুবসমাজকে এ শিক্ষা দেয়া এক ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে নিঃশব্দ ‘নরহত্যা’। হত্যাকাণ্ডে দেহ ধ্বংস হয় আর এ শিক্ষায় ঘটে মানবমন তথা মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু। অতএব এ কাজ নরহত্যার চেয়েও মারাত্মক। (আগামী কাল সমাপ্য )
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী