জাকারিয়া খান সৌরভ
অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রব স্যার। আমার জীবনে দেখা একজন সাদা মনের মানুষ তিনি! কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সদর ইউনিয়নের আরাগআনন্দপুর গ্রামের এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪১ (১৭ই বৈশাখ ১৩৪৮ বাংলা) সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ্ব মৌলভী মোঃ আবদুল জলিল যিনি জলিল মৌলভী নামে পরিচিত ও মাতার নাম সামসুন্নাহার বেগম। তার পিতা মৌলভী মোঃ আবদুল জলিল জেলা জুড়ি বোর্ডের সদস্য ও ৭নং বুড়িচং ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
৫ ভাই ১ বোনের মাঝে অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রব সবার বড়। তার দ্বিতীয় ভাই জনাব মোঃ আবদুল অদুদ ২০০৮ সালে বুড়িচং উপজেলা সমবায় অফিসার ও তৃতীয় ভাই জনাব মোঃ আবদুল মজিদ ২০১৬ সালে সোনালী ব্যাংক বুড়িচং শাখা হতে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। চতুর্থ ভাই মরহুম আবদুল ওহাব শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটিয়েছিলেন। পঞ্চম ভাই জনাব মোঃ আবু জাফর বুড়িচং মুসলিম লাইব্রেরীর সত্ত্বাধিকারী। আরাগআনন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েই জনাব আবদুর রবের পড়াশুনার হাতে খড়ি। পরে তিনি বুড়িচং জুনিয়র মাদ্রাসায়ও পড়াশুনা করেছেন। এ সময় তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে জালালাবাদ রেঞ্জে ফাস্ট গ্রেডে বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬১ সালে ইন্টারমেডিয়েট আর্টস (আই.এ), ১৯৬৩ সালে বি.এ (পাস কোর্স) ও ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী সাহিত্যে এম.এ প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান লাভ করেনে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মেয়ের জামাই ড. সিরাজুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরপরই পাকিস্তানের রাউলপিন্ডিতে তার সরকারী চাকুরীর ডাক পড়ে। বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া লাগবে তাই তিনি সরকারী চাকুরীতে যোগ দেননি!
কর্মজীবনে তিনি ১৯৬৬-১৯৭০ পর্যন্ত বুড়িচং আনন্দ হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক, ১৯৭০-১৯৭৯ পর্যন্ত সাহেবাবাদ ডিগ্রী কলেজে আরবি প্রভাষক, ১৯৮০-১৯৮১ পর্যন্ত জগতপুর এডিএইচ সিনিয়র ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায় অতিরিক্ত শিক্ষক, ১৯৮২-১৯৯৯ পর্যন্ত সাহেবাবাদ ডিগ্রী কলেজে আরবি প্রভাষক ও সর্বশেষ ১৯৯৯-২০০১ পর্যন্ত সাহেবাবাদ ডিগ্রী কলেজে অনারারি প্রভাষক হিসেবে চাকুরী করেন। চাকুরীর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৭৪-১৯৮০ অভিবক্ত বুড়িচং (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) থানা জামায়াতের ইনচার্জ, ২০০৭-২০১১ পর্যন্ত আরাগআনন্দপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি ইসলামীক ডেমোক্রেটিক লীগ (IDL)-এর বুড়িচং উপজেলা শাখার প্রশিক্ষণ সম্পাদক ও আরাগআনন্দপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পায়ে হেটে ১০/১২ বছর যাবত ১০০ কপি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা বিলি করে যাচ্ছেন। ২০০৪ সালে তিনি পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।
১৯৬৭ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি রাজধানী ঢাকার নয়াটোলাস্থ মধুবাগের কুলকন্ট্রলার মরহুম আবদুল কাদিরের জৈষ্ঠ্য সন্তান মনোয়ারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম মারা গেলে একই বছররের অক্টোবর মাসে তিনি কুমিল্লার পুরাতন চৌধুরীপাড়াস্থ মাওলানা নুর মোহাম্মদ সিদ্দিকীর তৃতীয় সন্তান সাউদা সিদ্দিকাকে বিয়ে করেন। উভয় সংসারে তার ৮ ছেলে ও ৪ মেয়ে রয়েছে। তার বড় ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করে স্বপরিবারে আমেরিকাতে বসবাস করছেন। দ্বিতীয় ছেলে মোঃ হারুনুর রশিদ ভোলা সরকারি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজ অধ্যাপনা করছেন, তৃতীয় ছেলে আবদুল হাই বাবু ১৯৯৮ সাল থেকে সৌদিআরবে প্রবাস জীবন-যাপন করছেন, চতুর্থ ছেলে আবদুর রহমান ব্যাংকার, পঞ্চম ছেলে সাইফুল ইসলাম উদ্যাক্তা। বাকী সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
বুড়িচং আনন্দ হাইস্কুলে শিক্ষকতার সময়ে স্যারের একটি ঘটনা প্রিয় পাঠকদের জন্য তোলে ধরা হলে-
কোন একজন স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার বুড়িচং আনন্দ হাইস্কুলে শিক্ষকতার সময় আপনি নাকি বেতন কমানোর দরখাস্ত করছিলেন? আসলে ব্যাপারটা কি? স্যার বললেন, আমাকে ১৩০ টাকা বেতন দেয়া হতো। আসলে আমার কাছে মনে হলো আমি যা পড়াই তাতে ৯০ টাকার বেশি হলে তা বেশি হয়ে যায়। তাই বেতন কমানোর জন্য দরখাস্ত দিয়েছিলাম, না হলে চাকরি করবো না। তার প্রেক্ষিতে বেতন ৯০ টাকা করা হয়েছিলো। ভাবা যায় তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাম করা যুবকের এমন কর্ম!!
অন্য আরেক দিনের ঘটনা। স্যার তখন সাহেবাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করেন। তো একদিন স্যার রিক্সা করে কলেজে যাচ্ছেন। রিক্স্যার ড্রাইভার স্যারকে বললেন, স্যার আপনিতো ছুটির পরে আবার রিক্সা করেই বাড়ি যাবেন। আমিই আপনাকে আমার রিক্সা করে নিয়ে যাবো। তো কয়টায় আপনার কলেজ ছুটি হবে? আমি স্টেশনেই থাকবো। যথারীতি কলেজ ছুটি হলে স্যার স্টেশনে গিয়ে ওই রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রিক্সার ড্রাইভার হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন স্যারকে নিয়ে যাবার কথা! স্যার দেড়/দুই ঘন্টা স্টেশনেই ঘুরাঘুরি করছেন। অন্য ড্রাইভাররা স্যারকে নিতে চাইলে স্যারের এক কথা। আগের বলে রাখা রিক্সায়ই তিনি যাবেন। পরে অন্য ড্রাইভারা আগের বলে রাখা ড্রাইভারকে খোঁজে আনলে স্যার ওই রিক্সা করেই বাড়ি ফেরেন।
আরেক দিনের ঘটনা। যেটা আমি নিজে স্যারের ছোট ভাই জনাব আবদুল ওয়াদুদের কাছ থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, কোন এক পারিবারিক বিষয়ে আমরা ভাইয়েরা দ্বিমত পোষণ করি। ভাইসাব (রব স্যার) এক রকম বললেন আর আমি অন্য রকম বললাম। এদিন ভাইসাবের সাথে একটু মন কষাকষি হয়। পরদিন ভোরবেলা দেখি ভাইসাব আমার ঘরের দরজায় দাড়ানো। আমি সালাম দেই। সালামের জবাব দিয়ে ভাইসাব বলেন, গতকালের বিষয়ে যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে সে জন্য আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও এবং আল্লাহ যেন আমাদের ক্ষমা করে দেন। (ভাইসাব থাকেন আরাগআনন্দপুরের বাড়িতে আর আমি থাকি বুড়িচংয়ের বাড়িতে)!
আমরা মহান রবের কাছে স্যারের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি এবং স্যারের প্রতিটি নেক কাজের জাযায়ে খায়ের কামনা করছি।
কমেন্ট করুন